নীলুফার ইয়াসমিন হাসান
আজ ১০ই মার্চ রোববার যুক্তরাজ্যে উদযাপিত হচ্ছে মা দিবস।
মূল উদ্দেশ্য হলো মাকে যথাযথ সম্মান দেওয়া। আগামী ১২ই মে বাংলাদেশ, আমেরিকা, ইউরোপের কিছু দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ মা দিবস পালন করবে।
অনেকের প্রশ্ন, প্রায় সকল সন্তানই মা’কে ভালবাসে এবং সম্মান দেখায়। তবে কেন নির্দিষ্ট দিনের প্রয়োজন।
‘মা দিবস পালন’ এর পেছনে আছে অন্য দিবসগুলোর মত ইতিহাস।
এইদিনে সবাই ঝালাই করে নিতে পারে যে মায়ের প্রতি সঠিক দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করছে কি-না। দিবস পালনের অর্থ এই নয় যে ভালবাসা একদিনের। বরং সন্তানের উপলব্ধির সুযোগ আসে, ব্যাস্ত সময়ে মায়ের সাথে কথা বলার জন্য একটু সময় আছেতো!
দশমাস দশদিন গর্ভে ধারণ করে নাড়ী ছেড়া ধন যে সন্তান জন্ম দেন মা, সেই জন্মদাতা মা হলেন সব কিছুর উর্ধ্বে। মায়ের ভালবাসার কোন বিকল্প নেই।
সন্তানের জন্য মা কি করেন তা লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করা যাবেনা, এটা উপলব্ধির ব্যাপার। নিঃস্বার্থ ভালবাসা একমাত্র মায়ের কাছ থেকেই পাওয়া যায়। যারা মা হারা হয়েছেন তারাই বুঝেন যে তারা কি হারিয়েছেন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘মনে-পড়া‘ কবিতায় লিখেছেন,
‘মাকে আমার পড়ে না মনে।
শোবার ঘরের কোণে;
শুধু যখন বসি গিয়ে জানলা থেকে তাকাই দূরে
নীল আকাশের দিকে
মনে হয়, মা আমার পানে
চাইছে অনিমিখে।
কোলের ‘পরে ধরে কবে
দেখত আমায় চেয়ে,
সেই চাউনি রেখে গেছে
সারা আকাশ ছেয়ে।’
একটি দিন মায়ের গলা জড়িয়ে ধরিয়ে বলুন, ‘ল্যাপটপকে দিয়েছি ছুটি, মোবাইল করেছি বন্ধ, মা আজকের দিনটি শুধু তোমারই জন্য।‘
প্রাচীন গ্রীক এবং রোমান সভ্যতার সময় থেকেই একটি বিশেষ দিনে মা’কে সম্মান করার রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। আধুনিক বিশ্বে সব দেশে একই দিনে মা দিবস উদযাপিত না হলেও মা’কে সম্মানিত করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন দিনে মা দিবস বা মাদার্স ডে পালিত হয়ে থাকে। প্রত্যেকটি দেশের ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে এই দিবস উদযাপিত হয়।
চারশ‘ বছর আগে থেকেই যুক্তরাজ্যে মাদারিং সানডে’ পালনের সূত্রপাত হয়। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে এটি মাদার্স ডে বা মা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এখানে ইস্টার সানডে’র তিন সপ্তাহ আগের রোববারে মা দিবস পালিত হয়ে থাকে। সেই হিসেবে প্রতিবছর মার্চ মাসের মাঝামাঝি অথবা শেষে মা দিবস পালন করা হয়।
কথিত আছে যে, যেসব সন্তানেরা নিজ বাড়ী থেকে অনেক দূরে কাজ করতো, তারা যাতে বছরে একদিন তাদের মাদার চার্চে আসার সুযোগ পায়, তারজন্য একটি নির্দিষ্ট দিনে ছুটি দেয়া হতো।
জন্মের পর যে চার্চে শিশুর ব্যাপটাইজড্ হয় সে চার্চটিই হচ্ছে ঐ শিশুর মাদার চার্চ।
ছুটি পেয়ে কর্মরত সন্তানেরা যখন দূর-দূরান্ত থেকে নিজ বাড়ী আসতো, তারা মায়েদের জন্য নানা ধরনের উপহার সামগ্রী নিয়ে আসতো। সেই থেকে শুরু হয় মাদারিং সানডে পালনের প্রচলন। কালের ধারায় ক্রমান্বয়ে এটি রূপান্তুরিত হয় মাদার্সডে- উৎসবে এবং মাকে উপহার দেয়ার রেওয়াজও শুরু হয়।
মা দিবসে সবাই চেষ্টা করে মাকে অন্ততঃ একটি কার্ড ও একগুচ্ছ ফুল দিতে। কিন্ত ইদানিংকালে মা দিবসে উপহারের তালিকায় এসেছে নানা বৈচিত্র। এক হিসেবে দেখা গেছে ব্রিটেনবাসী ভালবাসা দিবসের চেয়েও বেশী অর্থ ব্যয় করে মা দিবসের উপহারে। নামী দামী রেস্তোরাঁয় মাকে নিয়ে খাওয়া দাওয়ার পাশাপাশি উপহারও দেওয়া হয় ।
তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মা দিবসের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা। যুক্তরাষ্ট্রে নারীবাদী সমাজকর্মী জুলিয়া ওয়ার্ড হো সর্বপ্রথম ১৮৭০ সালে মা দিবস পালন করার আহবান জানান। মূলতঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধ এবং ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের পর নিরস্ত্রীকরণের সমর্থনে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে মহিলাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা নিশ্চিত করার জন্যই জুলিয়া ওয়ার্ড হো মা দিবস পালন করার আহবান জানিয়েছিলেন। এরপর ১৮৮০ এবং ১৮৯০ এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি সুনির্দিষ্ট দিনে মা দিবস উদযাপনের চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু ঐসব উদ্যোগ জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি লাভ করতে পারেনি।
ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার গ্রাফ্টন এলাকার এ্যানা জার্ভিস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান মা দিবসের প্রতিষ্ঠাতা। প্রত্যেকে যাতে বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে মা’কে সম্মানিত করতে পারেন তার জন্য তিনি এই দিবসটির সূত্রপাত করেন। এ্যানা জার্ভিসের মা এ্যান মেরী রীভস জার্ভিস সারা জীবন অনাথদের সেবা করেছেন। তিনি ১৯০৫ সালে মারা য়ান।
লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে কাজ করে যাওয়া তার সমাজকর্মী মায়ের স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই এই দিবসটিকে একটি উৎসবের দিন হিসেবে পালন করতে চেয়েছিলেন এ্যানা।
১৯০৮ সালের ১০ই মে মায়ের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে এ্যানা সকল মায়েদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য গ্রাফ্টনের সেন্ট এন্ড্রুজ মেথোডিস্ট চার্চে একটি সার্ভিস বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। ঐ সময় ফিলাডেলফিয়ায় বসবাসরত অবস্থায় তিনি সেখানেও অপর একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। তারপর থেকেই প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার মা দিবস উদযাপন শুরু হয়।
১৯১০ সালে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার গভর্নর সরকারীভাবে এই মা দিবস পালনের ঘোষণা দেন। ১৯১১ সালে যুক্তরাষ্টের অধিকাংশ রাজ্যেই এই দিবসটি পালিত হয়।
১৯১৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস এবং সিনেট মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে মা দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়ার জন্য একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ঐ প্রস্তাবটিতে অনুমোদন দেন। তারপর থেকে মা দিবস সরকারী দিবসের মর্যাদা পেতে থাকে।
এ বছর যুক্তরাষ্ট্রে ৮ই মে রোববার মা দিবস পালিত হবে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রেওয়াজ অনুসরণ করা হয়ে থাকে।
এ্যানা জার্ভিস ৮৪ বছর বয়সে ১৯৪৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। এ্যানার জীবদ্দশায়ই ‘মা দিবস’ মার্কিন মুল্লুকে অন্যতম একটি বাণিজ্যিক দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে। তিনি মা দিবসের এই বাণিজ্যিকরণের ঘোর বিরোধী ছিলেন।
কিন্তু কালের বিবর্তনে মা দিবস ক্রমান্বয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অন্যতম ব্যয়বহুল দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
ফ্রান্সে মে মাসের চতুর্থ রোববারে, নরওয়েতে ফেব্রুয়ারীর দ্বিতীয় বোরবারে এবং আরব বিশ্বে অনেক স্থানে ২১ শে মার্চ মা দিবস উদযপিত হয়।
১৯৪৩ সালে মিসরের সাংবাদিক মুস্তফা আমীন মা দিবস পালনের উদ্যোগ নেন। পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুল নাসের ২১শে মার্চকে মা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেন।
এদিকে বিবি ফাতেমার জন্মদিনে ইরানেও মা দিবস পালিত হয়। আবার থাইল্যান্ডে রাণী সিরিকিট- এর জন্মদিনে পালিত হয় এই দিবস। রাশিয়াতে নভেম্বর মাসের শেষ রোববার মা দিবস পালন করে।
তবে, ইতোপূর্বে কমিউনিস্ট শাসিত সোভিয়েত ইউনিয়নে ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসেই পালিত হতো মা দিবস।
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক এবং কলামিস্ট।